অস্তিত্বহীন চলনবিলের মৃতপ্রায় ১৬ নদী
নাম আছে। অস্তৃত্ব নেই। কোথাও সরু খাল। কোথাও কাঁচা পাকা স্থাপনা। কোথাও আবার গড়ে ওঠেছে অবৈধ পুকুর। সব মিলিয়ে পানি প্রবাহের কোন ব্যবস্থা নেই। পম পাথুরিয়া থেকে বিলকাঠোর। দির্ঘ ১৭ কিলোমিটারের এই এলাকাজুড়ে এমন পরিস্থিতি। গুরুদাসপুরের তুলশীগঙ্গা ও মির্জা মামুদ নামের দুটি নদীর বর্তমান অবস্থা এটি। নদী দুটি কেবল মানচিত্র সর্বস্য হয়ে পড়েছে।
অথচ আশির দশকের শেষের দিকেও এই নদী দুটি ছিল খর¯্রােতা। বছরজুড়েই ছোট বড় নৌকা চলাচল করতো। শুষ‹ মওসুমে নদীর পানিতে কৃষকরা অন্তত ১৫টি বিলে নির্বিঘেœ চাষাবাদ করতেন। জেলেরা উন্মুক্ত জলরাশিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নদী দখল হয়েছে। প্রভাবশালীরা নদী ভরাট করে স্থাপনা, দোকান পাট নির্মাণ করেছেন। খনন করা হয়েছে অনেক পুকুরও। মরা নদীতে আর পানি প্রবেশ করেনা। বরং বর্ষায় সৃষ্ট পানি নিস্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতায় হচ্ছে ফসলহানি।
গুরুদাসপুর ভূমি অফিসের তথ্যে জানাগেছে, উপজেলা চাপিলা ইউনিয়নের পম পাথুরিয়া থেকে শুরু হয়ে খামারপাথুরিয়া, নওপাড়া, তেলটুপি, পুঠিমারি হয়ে রওসনপুর নাজিরপুরের বৃকাশো মৌজায় এসে মির্জামামুদ নদীতে মিলিত হয় তুলশিগঙ্গা নদী। সেখান থেকে ধারাবারিষার সন্তোষপুর, বিন্যাবাড়ি, নারিবাড়ি দক্ষিণ পাড়া, পাঁচশিশা, চলনালী, চরকাদহ, মশিন্দার হাঁসমারি, দরি হাঁসমারি, বামনগাঁড়া, কাছিকাটা হয়ে বিলকাঠোর এস আত্রাই গুমানী নদীতে এসে তুলশিগঙ্গা নদী মিলিত হয়। সিএস নকশায় এমন দেখা গেলেও নদী দুটির ব্যস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।
শুধু যে তুলশিগঙ্গা আর মির্জামামুদ নদীর এমন করুন দশা তা নয়। চলনবিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রায় ১৬টি নদী এখন মৃতপ্রায়। বর্ষায় আত্রাই, গুমানি, নন্দকুঁজা নদীতে কোনমতে পানি প্রবাহ থাকে। বাস্তবতায় এসব নদীরও পাড় ঘেঁষে স্থাপনা নির্মাণ অব্যহত রয়েছে।
নদীপাড়ের বাশিন্দারা জানান, নদী খেকোদের প্রভাব, দখল-দুষণ আর ভরাটের কবলে পড়ে আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, বড়ালসহ চলনবিলের প্রধান ১৬ টি নদ-নদী অস্তৃত্ব সংকটে পড়েছে। অনেক নদী একেবারে মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে চলনবিলের আয়তন। কয়েক দশক ধরে শুস্ক মওসুম ছাড়া বর্ষা মওসুমেও পানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। এতে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে কৃষি উৎপাদন। নদীপাড়ের মানুষ পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ব নদী রক্ষা দিবসকে সামনে রেখে ২০০৮ সাল থেকে ‘চলনবিল ও নদ-নদী রক্ষায়’ বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলন চলছে। ১৪ মার্চ বিশ্ব নদী রক্ষা দিবস। ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর নদী বিষয়ক টাস্কফোর্সের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য পুনরায় বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির উদ্দ্যেগে চলনবিল অঞ্চলের প্রায় ১ লাখ মানুষের গণস্বাক্ষরিত ৬টি দাবি সংবলিত একটি স্বারক লিপি প্রাধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হয়। মূলত এর পরেই পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়ালসহ চলনবিলের নদীগুলো দখলমুক্তকরণ ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে আই ডব্লিউ এম নামের গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানকে সমীক্ষার দায়িত্ব প্রদান করে। ওই প্রকল্পে শুধু মাত্র বড়াল ও নারোদ নদ পূনর্খননে সমীক্ষা চলছে। তুলশী গঙ্গা, মির্জামামুদ, আত্রাই নন্দকুঁজা, গুমানীসহ অন্যন্য নদী রক্ষার ব্যাপারে দৃশ্যত কোন পদক্ষেপ নেই।
ইম্পেরিয়েল গেজেট অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কি.মি. আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান নদী ৯টি, ২০টি খালসহ ছোট ছোট বিভিন্ন বিল ও খাল রয়েছে। অতীতে ২৩ হাজারের মত বড় বড় পানির আধার ছিল। যা বেশীর ভাগই বেদখলকৃত ও হাত ছাড়া হয়ে গেছে।
চাটমোহর বড়াল রক্ষা আন্দোলণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান মজনু জানান, নদী রক্ষা দিবস উপলক্ষে দখলমুক্তকরণ, বাঁধ অপসারণ, পুনঃখনন ও ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে তারা আজ নন্দকুঁজা নদীর পাড় ঘেষে মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন। এছাড়া ‘নদী বাঁচাও’ শ্লোগানের ব্যানার নিয়ে নদী পাড়ের চার জেলার আট উপজেলার মানুষ ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পৃথিবীর বৃহত্তম মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে।
চলনবিলের নদী ও খালের মধ্যে,- আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলশি, চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা ইত্যাদি। ১৮টি খালের মধ্যে নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মো. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, প্রায় ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে বছর জুড়েই নৌ-চলাচল করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে। পরিসংখ্যানমতে, প্রতি বছর ২২২১/২ মিলিয়ন ঘণফুট পলি প্রবেশ করে, ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বর্ষায় চলনবিল ত্যাগ করে।
ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে-জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ফারাক্কার বাঁধ বিরুপ প্রভাব ও ৮০’র দশকে পদ্মার উৎস মুখে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদ-নদী ও বিল, জলাশয়, খালগুলোতে পলি জমে ক্রমশঃ ভরাট হয়ে গেছে। তাছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছাভাবে সড়ক, ব্রীজ-কালভার্ট, নদী দখল করে বসতি, দোকান পাট স্থাপন করায় নদীগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের চলনবিল মৎস্য প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ হতে ২০০৬ সালের মধ্যে এক সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৮২ সালে মোট ১,৭৭,০৬১ জেলে এসব নদ-নদী ও খাল জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। পর্যায়ক্রমে কমতে কমতে ২০০৬ সালে এর সংখ্যা ৭৫,০০০ জনে দাঁড়ায়।
বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারি আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও মিজানুর রহমান জানান, দেশের বৃহত্তম পদ্মা-যমুনা নদী এবং জলাভুমি বিশাল চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ নদী হচ্ছে বড়াল। এই নদী ৪টি জেলা ও ৮টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। রাজশাহীর চারঘাট থেকে উৎপত্তি হয়ে চলনবিলের মধ্যে দিয়ে মুশাখা, নন্দকুজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুড়াসাগর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। এক সময় এই নদী ছিল প্রবাহমান। কিন্তু ৮০’র দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিত ভাবে নদীর উৎস মুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিয়ায় স্লুইসগেট নির্মাণ, পাবনার চাটমোহরে তিনটি ক্রস বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে প্রমত্তা বড়াল বর্তমানে পুকুরে পরিণত হয়েছে। এছাড়া চলনবিলের প্রধান নদী আত্রাই, নন্দকুঁজা ও গুমানীসহ ১৬ টি নদ-নদীতে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আই ডব্লিউ এম) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে ‘বড়াল নদী অববাহিকায় পানি সম্পদকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ণসহ বিস্তারিত সম্ভাবনা যাচাই’ প্রকল্প দেওয়া হয়। এই সমীক্ষার মাধ্যমে নদীর অতীত বর্তমান এবং ভবিষৎ পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রায় ২ হাজার ৫’শটি ক্রস সেকশন, ব্রীজ-কালভার্ট, বাঁধ নির্ণয় করা হয়েছে। তাছাড়া নদীগুলোর জ্যামিতিক মডেলিংয়ের কাজও করা হয়েছে। তবে প্রকল্পটির মেয়াদ ১৮ মাস থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে তা শেষ হয়নি।
ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আই ডব্লিউ এম) এর ইরিগেশণ ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের সিনিয়র স্পেশালিষ্ট ওই প্রকল্পের টিম লিডার মো. তারিকুল ইসলাম মুক্ত প্রভাতকে বলেন, চারঘাট থেকে আটঘরিয়া থেকে চাটমোহর ৫৫ কিলোমিটার এবং চারঘাট থেকে বাগাতিপাড়া পর্যন্ত বড়াল নদী পূর্ণখনন করা হচ্ছে। বড়াল নদীর গড় গভীরতা হবে পাড় থেকে ৮ মিটার এবং প্রস্থ হবে ৫৪ মিটার।
বড়াইগ্রাম বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব ডি এম আলমগীর জানান, বড়াল নদী চালু ও তা রক্ষার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও সর্বস্তরের মানুষ গত ২০০৮ সাল থেকে আন্দোলনে নামে। বড়ালসহ চলনবিলের সকল নদীর ওপর নির্মিত সকল স্লুইসগেট-বাঁধ অপসারণ করে সেখানে প্রস্থ সেতু নির্মাণ করা সহ নদীর সীমানা চিহ্নিত ও দখলদার উচ্ছেদ করে অচল নদী সচল করতেই বিভিন্ন আন্দোলন।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, গঙ্গা ব্যারেজের কারণে উজানে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বড়ালের নাব্যতা কমে গেছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা। তবে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে। তাছাড়া ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আই ডব্লিউ এম) প্রতিষ্ঠানকে সমীক্ষা প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। সমীক্ষা প্রতিবেদন এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করা হবে।
নাটোর জেলা আ’লীগের সভাপতি (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের সাংসদ আব্দুল কুদ্দুস বলেন, চলনবিলসহ বড়াল নদীকে রক্ষা করতে পারলে উত্তরের ৮ উপজেলার এককোটি মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা অব্যহত থাকবে। বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাবে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ।