বই পড়ায় পাঠকের আগ্রহ নেই
বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেই চলেছে। এখন আর লাইব্রেরী, গ্রন্থাগারে পাঠক পাওয়া যায়না। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বাইয়ের পাঠকগুলো এখন ব্যস্ত ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, টেভিশন ইত্যাদি নিয়ে। পড়ার আগ্রহ নেই কারো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,- বই পড়ার প্রতি পাঠকের আগ্রহ কমার কারণ হলো, মানসম্মত বই বাজারে নেই। ভালো লেখকও নেই। কাগজের দাম অব্যহত ভাবে বেশি হওয়ায় বইয়ের দাম বাড়ছে। যা দুএকটা মানসম্মত লেখকের রুচিশীল বই বের হচ্ছে দাম বাড়ায় সেসব বইও পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারছেনা। আবার হাজার হাজার বই সমৃদ্ধ লাবব্রেরীগুলো বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বন্ধে পথে রয়েছে। একারনে বই পাঠকের সিমাহীন দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এমনই দুইটি গ্রন্থাগাড়েরর সচিত্র প্রতিবেন তুলে ধরা হলো।
অর্থাভাবে বন্ধের উক্রম গুরুদাসপুর কেন্দ্রীয় পাঠাগার
প্রবেশ পথে তালা ঝুলানো। পড়ার টেবিলে ধুলো-বালির পরত। ময়লার আস্তরে ঢাঁকা পাঠ কক্ষে আর হয়না বই পড়া। খাতায় ওঠা শেষ হাজিরাটিও সাত মাস আগের। তাকে সাজানো বইয়ে সর্বত্রই স্পর্শহীনতা, অযন্ত-অবহেলার ছাপ।
পাঠাগারের সঙ্গীহীন এসব ‘বইয়ের সাথে এখন সৃষ্টি হয়েছে পাঠকের সীমাহীন দুরত্ব’। ভাটা পড়েছে পাঠাগারের কার্যক্রমে। চারটি তাকে সাজানো সারে তিন হাজার বই সমৃদ্ধ কেন্দ্রীয় পাঠাগারটি মূলত সাইনবোর্ড স্বর্বস্য হয়ে পড়েছে। অথচ ক’দিন আগেও পাঠকক্ষে দল বেঁধে চলতো বই পড়া। সঙ্গিত চর্চা আর পত্রিকা পড়াও ছিল নিত্যদিনের কর্মসূচিতে। সপ্তাহের ছুটির দিন ব্যতিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হতো পাঠাগার। এসব কার্যক্রম নিয়মিতই চলছিল সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত। হঠাৎ অর্থ-জনবল সংকটের ফলে পাঠাগারটি আগের মতো আর খোলা হয় না। বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োগপ্রাপ্ত লাইব্রেরীয়ান শামীম হোসেন নিজ অর্থে পাঠাগারটি পরিচালনা করছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় আবুল কালাম নামের একজন ব্যক্তি লাইব্রেরীয়ানের দায়িত্ব পালন করেন। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তারপর সালামত নামের একজন পুনরায় ওই দায়িত্বভার গ্রহন করেন। আর্থিক সুবিধা না থাকায় সালামতও দায়িত্ব ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে অর্থ জনবল সংকটে পাঠাগারটি সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে যায়। সেটা ২০০৮ সালের কথা।
দীর্ঘ তিন বছর বন্ধ থাকার পর ২০১১ সালের নভেম্বরে মোছা. মাজেদা ইয়াছমিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে পাঠাগারটি চালুর উদ্দ্যোগ নেন। স্থানীয় কলেজ শিক্ষক আবু শামীমকে বিনা বেতনে লাইব্রেরীয়ান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সে সময় অনুদান হিসাবে ১২০টি বই পাওয়া যায়। সাথে যোগ হয় শামীমের অন্য একটি সংগঠন গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার (সিডিএল) এর ২ হাজার বই। কেন্দ্রীয় এই পাঠাগারের বই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজারের ওপরে। সিডিএলের আসবাবপত্রেই কেন্দ্রীয় পাঠাগারের কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। ২০১৪ সালে স্থানীয় সাংসদ ও উপজলা চেয়ারম্যানের দেওয়া অনুদানের টাকায় পাঠাগারের পুরাতন বিল্ডিংয়ের ছাদ মেরামত, পানির লাইনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। এছাড়া নাটোর জেলা পরিষদ হতে বঙ্গবন্ধুর ওপর ২৬টি বই অনুদান পাওয়া যায়। এরপর আর নতুন কোন বই পাঠাগারে যোগ হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, আর্থিক সুবিধা ছাড়াই শামীম পাঠাগারটি নিয়মিত খোলাসহ সকল প্রকার কাজ করতেন নিজেই। ৩ হাজার বই সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারে তিনি আরও যোগ করেন সঙ্গিত চর্চা, বাংলা, ইংরেজিসহ জাতীয় দৈনিক পত্রিকা পড়া। একসাথে বই পত্রিকা পড়া আর সঙ্গিত চর্চার বিষয়টি এলাকায় বেশ সাড়া ফেলে। পাঠাগারে বেড়ে যায় সকল শ্রেণি পেশার মানুষের উপস্থিতি।
লাইব্রেরীয়ান শামীম হোসেন বলেন, প্রায় পাঁচ বছর নিজের অর্থে পাঠাগারটি পরিচালনা করছিলেন তিনি। পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি নিজ অর্থে ২ হাজার টাকা বেতনে হাসিনা বেগম ও শিউলি আক্তার নামের দুইজন অফিস সহকারি নিয়োগ করেন। তখন সকাল নয়টার মধ্যে পাঠাগার খোলা হতো নিয়মিত। শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ এখানে এসে কেউ বই পড়তেন, কেউ পত্রিকা, কেউবা সঙ্গিত চর্চা করতেন। গুরুদাসপুর কেন্দ্রীয় পাঠাগারটি এলাকায় বেশ পরিচিত হয়ে উঠে।
বছর দুয়েক চাকরি করার পর পাঠাগার ছাড়েন অফিস সহকারী দুই মহিলা। তারপর থেকে দিনের প্রথম বেলায় আর পাঠাগারটি খোলা হয়না। এখন নিজের কর্মস্থলে কাটে দিনের প্রথম বেলা। আর বিকালে পাঠাগারটি খোলেন নিজেই। পত্রিকা-বিদ্যুৎ বিলসহ যাবতীয় খরচ মেটাতেন নিজের অর্থেই।
তিনি বলেন, সকালের দিকে পাঠক সমাগম বেশি হতো। আর বিকালে কোন পাঠক পাঠাগারে আসে না। কারন ওই সময় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট-কোচিং আর খেলা-ধুলায় ব্যস্ত থাকে। বেশি বেতনে অফিস সহকারী নিয়োগ করা সম্ভব না হলেও পাঠকের কথা বিবেচনা করে কষ্ট-সৃষ্টে নিজের অর্থে পাঠাগারটি প্রতিদিন বিকালেই খোলেন তিনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পত্রিকা পড়ার জন্য বেলকোনিতে দুইটি টেবিল ও দশটি চেয়ার রয়েছে। একটু ভেতরেই রয়েছে ১২ফিট দৈর্ঘ্য ১৫ ফিট প্রস্থের পাঠ কক্ষ। ওই কক্ষের চারদিকেই তাকে সাজানো হাজারো বই। রয়েছে পড়ার টেবিল। এই কক্ষের বাম পাশে ছোট্ট কক্ষে রয়েছে সঙ্গিত চর্চার ব্যবস্থা। আর ডান পাশে লাইব্রেরীয়ান শামীমের অফিস কক্ষ।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, পাঠাগারটি আধুনিকায়ন করার চেষ্টা চলছে। এদিকে চাঁচকৈড় শিক্ষা সংঘের কয়েক হাজার বই সমৃদ্ধ গ্রন্থারটি দীঘদিন ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। বইগুলোতে ধুলোর পরত পড়েছে। তবুও গ্রন্থাগার নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই।