মসজিদ মন্দিরের শত বছরের সেই সম্প্রীতি এখনো অটুট
শাহিনুর ইসলাম প্রান্ত, লালমনিরহাট প্রতিনিধি
দুইটি ধর্মীয় উপসানালয়। একটি মসজিদ। অপরটি মন্দির। একটি বাজারের একই ব্যাসার্ধের মধ্য দুটির অবস্থান। এখানে নামাজ পূজা দুটো এক সাথেই চলে। তবে নেই কোন ধর্মীয় রেষা রেষি। দুই ধর্মের মানুষের মধ্যই রয়েছে সম্প্রীতি। এমন সম্পীতি চলে আসছে প্রায় শত বছরেও বেশি আগে থেকে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির এই অপূর্ব দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়ি বাজারে। একই উঠানে মসজিদ ও মন্দিরের অবস্থান। এক পাশে ধুপকাটি অন্য পাশে আতরের ঘ্রাণে মুখর। একপাশে উলুধ্বনী অন্যপাশে মসজিদে চলছে আল্লাহর জিকির। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলছে পৃথক দুইটি ধর্মের উপাসনালয়ে প্রার্থনা।
এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘদিন ধরে একই উঠানে মসজিদ-মন্দির হলেও উভয় ধর্মের মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে থেকে স্ব স্ব ধর্ম পালন করে আসছেন। ধর্ম পালন নিয়ে কখনও কোনো বাকবিতণ্ডা পর্যন্ত হয়নি। উভয় ধর্মের শালীনতা বজায় রেখেই একই উঠোনে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন উভয় ধর্মের মানুষ। শুধু নামাজ বা পূজা অর্চনাই নয়, উভয় ধর্মের সকল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শান্তিপুর্ণ ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়েই পালন করছেন এখানকার মানুষ।
কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী মন্দির কমিটির কোষাধ্যক্ষক সনদ চন্দ্র সাহা বলেন, প্রায় দেড়শত বছর আগে কালীমন্দির হিসেবে এ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যার কারণে এলাকাটির নামকরণও করা হয় কালীবাড়ী। বাজার গড়ে উঠলে বাজারের ব্যবসায়ী ও শহরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মন্দিরের পাশেই এ পুড়োনো বাজার জামে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে একটা উঠানে চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়।
তিনি আরো বলেন, পূঁজা শুরুর আগে মসজিদ ও মন্দির কমিটি বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত মতে, আজানের সময় থেকে প্রথম জামায়াত নামাজ পর্যন্ত মন্দিরের মাইক, ঢাক ঢোলসহ যাবতীয় শব্দ বন্ধ থাকবে। কিন্তু ওই সময় পুরোহীত ও পুজারীরা কোন রকম শব্দ ছাড়াই নিরবে তাদের পূজা চালিয়ে যাবেন। নামাজের প্রথম জামায়াত শেষ হলে মন্দিরের কার্যক্রম আবার স্বাভাবিক হয়। সামান্যতম বিশৃঙ্খলা হয় না এখানে। বছরের পর বছর এমন সম্প্রীতিই দেখছেন স্থানীয় সনদ চন্দ্র সাহা।
লালমনিরহাট পুরান বাজার কালীবাড়ি দুর্গা মন্দিরের সভাপতি জীবন কুমার সাহা বলেন, ১৮৩৬ সালে দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে এখানে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুড়োনো বাজার এলাকা অনেকের কাছে কালিবাড়ি নামে পরিচিত হয়ে উঠে। এরপর মন্দির প্রাঙ্গণে ১৯০০ সালে একটি নামাজ ঘর নির্মিত হয়। এ নামাজ ঘরটিই পরবর্তীতে পুরাণ বাজার জামে মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর থেকে কোন বিবাদ ও ঝামেলা ছাড়াই সম্প্রীতির সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে আসছেন দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ।
দুর্গাপূজার সময় ঢাক ঢোল ও বাদ্য যন্ত্র বাজানো নিয়ে সমস্যা হয় কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চন্দ্র সাহা বলেন, আমরা মসজিদ ও মন্দির কমিটির সদস্যরা বসে ঠিক করে নেই কখন এবং কিভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা হবে। নামাজের সময়গুলোতে সকল প্রকার বাদ্য বাজনা বন্ধ রাখা হয় এবং নামাজ শেষে মসুল্লিরা দ্রুত মসজিদ ত্যাগ করে পূজারীদের জন্য সুযোগ করে দেন। এটাই এখানে নিয়ম।
পুরান বাজার জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফজল মিয়া বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতির এটি এক জ্বলন্ত প্রমাণ বা উদাহারণ। যুগ যুগ ধরে একই উঠানে চলছে নামাজ ও পূজা অর্চনা। নামাজের সময় মন্দিরের ঢাক ঢোল বন্ধ রাখা হয়। নামাজ শেষ হলে মন্দিরে পূজা চলে পুরোদমে। আযান ও নামাজে তো খুব বেশি সময় লাগে না। এ সময় টুকু তারা (পূজারী) ঢাক ঢোলসহ শব্দযন্ত্র বন্ধ রাখেন। কোন ধরনে বিশৃঙ্খলা ছাড়াই যুগ যুগ ধরে এ সম্প্রীতির বন্ধনে ধর্মীয় উৎসব পালন করছেন বলে দাবি করেন তিনি।
পুরাণ বাজার জামে মসজিদ সহকারী ইমাম মওলনা শফিকুল ইসলাম বলেন, উভয় ধর্মের লোকদের সম সুযোগ দিয়েই এখানে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরী করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তাই ধর্ম পালনে কারো কোনো সমস্যা হয় না।
লালমনিরহাট ডিসি শফিউল আরিফ বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ এ জেলার মানুষ। এটাই এখানকার মানুষ লালন করে এবং বিশ্বাস করে। যার মূর্ত প্রতীক এক উঠোনে কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী মন্দির ও পুরান বাজার জামে মসজিদ।
মুক্ত প্রভাত/রাশিদুল