ইটভাটার দখলে রায়গঞ্জের ফসলি জমি
এইচ এম মোনায়েম খান, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি-
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ৯ টি ইউনিয়নে ফসলি জমিতে বৈধ অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠেছে প্রায় ৬০টি ইটভাটা। নতুন ভাবে গড়ে উঠছে আরো ৩০ থেকে ৩৫টি। যদিও কয়েক বছর পূর্বে অত্র উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ২০টি। সেগুলোর কিছুটা বৈধতা মিললেও মিলছে না তার পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা প্রায় ৩৮টি ইটভাটার বৈধতা। যা নিয়ে স্থানীয় সচেতন মহলে বইছে সমালোচনার ঝড়।
অপরদিকে অবৈধ ইটভাটার মালিকরা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পেলেও খুব সহজেই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করেই হরদম চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ ইটভাটার রমরমা ব্যবসা।
এদিকে এভাবে মাত্রাতিরিক্ত ইটভাটা রায়গঞ্জ উপজেলায় বৃদ্ধি পাওয়ায় এলাকার কৃষি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। জনজীবনে দেখা দিয়েছে দুর্ভোগ। উপজেলা প্রশাসন ও সরজমিনে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মাণে আইনগত নিষেধ থাকলেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই রায়গঞ্জে প্রায় ৫০০ একর ফসলি জমিতে গড়ে ওঠেছে অবৈধ ইটভাটা।
প্রতিটি ইটভাটার আশপাশে ফসলি জমির সমারোহ তো আছেই। চাষ করা হয়েছে ধানের পাশাপাশি আলু, মরিচ, ডালসহ বিভিন্ন রবিশস্য। গত পাঁচ বছর ধরে খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে কাটা হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর (টপ সয়েল) মাটি। বলা চলে ইটভাটার দখলে চলে গেছে রায়গঞ্জের ফসলি জমি।
শুধু তাই নয় এসব ইট ভাটায় পুরুষের পাশাপাশি শিশুও কাজ করছে।
অপরদিকে ইট তৈরির মৌসুমগুলোতে সড়কের পাশে রাখা হয় মাটি ও জ্বালানি কয়লার স্তুপ। যন্ত্র দিয়ে সড়কের পাশে কয়লা ভাঙার সময় বিষাক্ত ধোঁয়া আর ধুলাবালিতে এলাকার পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠে। এতে পরিবহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তারা নাক চেপে ধরেও নিস্তার পায় না।
সরজমিনে উপজেলার জঞ্জালী পাড়ায় ঘুড়ে দেখা গেছে, পানাসি ও বরেন্দ্র প্রকল্পের মধ্যে একটি ইটভাটা গড়ে উঠছে। সেখানেও নেই কোন অনুমতি পত্র। দেওভোগ এলাকায় একটি ইটভাটা স্থাপন করা হচ্ছে সেটারও নেই কোন অনুমোদন। শুধুমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ছাড়পত্র নিয়ে তারা ইটভাটার কাজে নেমে পড়েছে।
এবিষয়ে ভাটা মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা প্রশাসনকে তারা ম্যানেজ করেই এসমস্ত ইটভাটার কাজ শুরু করেছে। তাছাড়া ইটভাটা করার কারো ক্ষমতা নেই।
অত্র উপজেলার ঘুড়কা ইউনিয়নের রগুনাথপুর গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় ফসলি জমিতে লাগামহীন ভাবে অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠছে। মোরদিয়ার মৌজায় গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে দুটি ভাটা পাশাপাশি থাকলেও নতুন করে আরও কয়েকটি ইটভাটা গড়ে ওঠছে। যার সিংহ ভাগ কাজ প্রায় শেষ। এমন চিত্র শুধু ঘুড়কা ইউনিয়নে নয় এ চিত্র অত্র উপজেলার ধানগড়া, ব্রম্মগাছা, চান্দাইকোনা ও পাঙ্গাসী ইউনিয়নগুলোতে। যার ফলে বোরো ফসল বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।
প্রতি মৌসুমে জমির ধান পাকা শুরু হলে কৃষকরা অধিক মাত্রায় ক্ষতির সম্মুখীন হন। মাত্রাতিরিক্ত ইটভাটা ঘোরে ওঠার ফলে গত বছর রায়গঞ্জ উপজেলার প্রায় ৫০ একর জমির বোরো ধানে চিটা হয়ে নষ্ট হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজ শিক্ষক বলেন, ইটভাটার ধুলা আর ধোঁয়ায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মালিক পক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বৈধ ইটভাটার মালিক জানান, মাঝে মাঝে নোটিশ করা হলেও এগুলো লোক দেখানো। নোটিশ করেই মাঠে নেমে পড়ে তারা। মোটা অংকের টাকা তুলে নিয়ে আবার চুপ হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, প্রশাসন যদি মনে করে অবৈধ ইটভাটা হতে দেওয়া হবে না। তাহলে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন ইটভাটা হতে পারবেনা।
রায়গঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হক মন্ডল বলেন, কৃষি জমির পাশেই অবৈধ ভাবে ইটভাটা গড়ে উঠছে। ইটভাটার কারণে এলাকার কৃষি আজ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। কৃষি জমির পাশে ইটভাটা হতে পারে না। এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমে কৃষকদের সচেতন করে যাচ্ছি কিন্তু এর লাগাম কিছুতেই ধরতে পারছি না।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহীর পরিদর্শক (দায়িত্ব প্রাপ্ত সিরাজগঞ্জ) মো. আতাউর রহমানের সাথে ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ রায়গঞ্জ উপজেলায় তালিকা অনুযায়ী ৪৮ টি ইটভাটা রয়েছে। যার মধ্যে ২২ টি ইটভাটার ছাড়পত্র পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ২৬টি ইটভাটা পরিবেশ বিপর্যয় করে কৃষকদের ক্ষতি করছে তাই ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। কিন্তু তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ এবং অপসারণের জন্য নৌটিশ প্রদান করা হয়েছে। যার এক কপি করে জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমানে অত্র উপজেলায় প্রায় ৬০টি ইটভাটা দৃশ্যমান এমন প্রশ্নের উত্তরে এই দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন,এ গুলো নতুন ভাবে গড়ে ওঠেছে যার তালিকা আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি দ্রুত ইট প্রস্তত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী সে গুলোর বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট এর মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রায়গঞ্জের উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল বাসেত জানান, অবৈধ ইটভাটার কারণে তার অধিদপ্তরের কোটি কোটি টাকার রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার নতুন রাস্তা করলেও তা টিকছে না।
রায়গঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আইনুল হক জানান, ভবিষতে রায়গঞ্জ মরুভুমিতে পরিনত হতে যাচ্ছে। এভাবে ইটভাটা হলেও কৃষি জমির পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
সিরাজগঞ্জের বিএডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী মাজেদুল আলম বলেন, কৃষি জমিতে যেহারে ইটভাটা হচ্ছে তা উদ্ধেগজনক। এইভাবে ইটভাটা হলে সিরাজগঞ্জে কৃষিতে বিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি আরো বলেন, স্থানীয় প্রশাসন সচেতন হলে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব।
হেনা আহমেদ/ মুক্ত প্রভাত