ধারাবাহিক গল্প : ইং বাং (পর্ব-৩)
একটা ছোট্ট টেবিলকে সামনে রেখে বসে আছেন কয়েকজন। একেবারে উত্তর দিকে যিনি বসে আছেন তার মুখ বিমর্ষে ভরা। কাঁচা দুধের আলতো ছোয়া লাগা সুন্দর মুখখানি কেমন মলিন হয়ে আছে যেন আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা। সারারাত ঘুম হয়নি তা মুখে সুস্পষ্ট। গতরাত আটটার সময় একটা ফোন আসার পর থেকেই এক অজানা আতঙ্ক, সম্মান হারানোর ভয়, প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হবার চিন্তায় মাথা কাজ করছে না। তাই তিনি রাত দশটার দিকে কয়েকজনকে ফোন করে স্কুল এন্ড কলেজের অফিসে ডেকে নেন। তার ডান পাশে বসে আছেন সফেদ দাড়িওয়ালা, মাথায় শুভ্র কেশধারী বুদ্ধিদ্বীপ্ত মানুষ। ইনি হলেন অত্র প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। অধ্যক্ষের শিক্ষকতুল্য সভাপতিকে অধ্যক্ষ সাহেব তার চেয়ারে বসার অনুরোধ করলেও সভাপতি সে চেয়ারে বসেননি। তিনি বলেছেন- মানুষের সম্মান হয় মন থেকে। আর প্রতিষ্ঠান প্রধানের চেয়ারে কখনও অন্য কারও বসা উচিৎ নয় হোক তিনি যত সম্মানীত বা অফিসার লেভেলের। তার যুক্তির অন্যথা করার সাধ্য কারও ছিল না। সভাপতির পরে বসেছেন কার্যকরী কমিটির এক নবীন সদস্য। এক এক করে বসে আছেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তিনজন। কলেজ লেভেল থেকে একজন ছাত্র, একজন ছাত্রী। হাইস্কুল লেভেলের অনুরুপ দু’জন। তিনজন অভিভাবক তার মধ্যে একজন মহিলা ও কমিটির একজন মহিলা সদস্য। সব শেষে বসেছেন স্কুল শাখার প্রবিণ শিক্ষক। আর তার পূর্বে বসেছে নবম শ্রেণির ছাত্র আহমদ আব্দুল্লাহ।
মিটিং চলার এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ সাহেব নিচু করা মুখ সবার সামনে তুলে ধরে বললেন- স্কুল এবং কলেজ এক সাথে হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হই এটা ঠিক আছে। আপনাদের দক্ষ হাতের ছোয়ায় সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। আপনারা জানেন বর্তমানের সমস্যা একটা জাতীয় ইস্যু। কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। গত রাতে আটটা সতেরো মিনিটে একজন সাংবাদিক জানালেন, আপনাদের অবহিত করা হয়েছে। তারপরেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। অগত্য দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি। সম্মানিত মানুষ হিসাবে আপনাদের দশদিন সময় দেয়া হলো যদি সমাধান না করেন তাহলে তা পত্রিকায় প্রকাশ করে দেয়া হবে।
কর্ণার থেকে একজন সচেতন মহিলা অভিভাবক যিনি মাঝে মাঝেই প্রতিষ্ঠানে আসেন এবং বিভিন্ন ভাল মন্দের খোঁজ খবর নেন তিনি বললেন, কিছু মনে করবেন না, কিছু টাকা পয়সা দিলেই তো ওদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
অধ্যক্ষ তাকালেন স্কুল শাখার প্রবিণ শিক্ষকের দিকে। তিনি বুঝলেন অধ্যক্ষ সাহেব চাচ্ছেন তিনি কিছু বলুন। প্রবিণ শিক্ষক বললেন, অধ্যক্ষ সাহেবের অনুরোধে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়েই বলেছিলাম কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
কমিটির নবীন সদস্য বললেন, কত টাকা হলে কথা শুনবে। এটা বের করার দরকার ছিল। এক হাজার, পাঁচ হাজার, দশ হাজার কথাতো এক সময় সে শুনবেই। দুইশত টাকা দিলে ওরা পিছনে পিছনে ঘুরতে ঘুরতে স্যান্ডেল ক্ষয় করে।
আমি সেরকম ইঙ্গিতও দিয়েছিলাম। যেহেতু এটা এমন একটা বিষয় যা প্রকাশ হয়ে পড়লে প্রতিষ্ঠানতো অবশ্যই আমাদেরও মান সম্মান বলতে আর কিছু থাকবে না। তাই আমি নাম প্রকাশ না করেই তাকে লক্ষাধীক টাকা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও তিনি রাজি হননি। বললেন প্রবিণ শিক্ষকটি। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আমার অফারে তিনি আশ্চর্য্য হন এবং আমি শিক্ষক কি-না তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। যা একজন শিক্ষকের কাছে খুবই অপমাণজনক। আমার লোভনীয় অফারের পরে তিনি বলেন, টাকা দিয়ে তিনি বিক্রি হবেন না। তিনি একাধারে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অন্যদিকে তার বাবা গ্রামের মসজিদে মারা না যাওয়া পর্যন্ত ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং আমাদের মনে হয় সঠিক পথে এগুনো দরকার।
অধ্যক্ষ সাহেব বললেন, আমরা যে বসে নেই তা তো আপনারা জানেন। আমরা আমাদের মতো করে এগুচ্ছি অন্যদিকে সভাপতি মহোদয়ের পরামর্শ মোতাবেক কয়েকজন ছাত্রের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারাও কাজ করছে। বলে তাকালেন আহমদ আব্দুল্লাহর দিকে।
আহমদ আব্দুল্লাহ নড়ে চড়ে বসে বলল, প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আমরা খুব একটা এগুতে পারিনি। তবে এগুনোর সুত্র পেয়ে যাব শীঘ্রই। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরী তা হলো আপনারা মিটিং করার পর আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আমার বাবাকে ফোন করে এক অজ্ঞাতনামা বলে দিয়েছেন, আমরা যে পথে আগাচ্ছি তাতে ফল খুব খারাপ হতে পারে। এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সামনে এগুনো আমাদের পক্ষে কঠিন।
চলবে—————-