ঘুনে ধরা শিক্ষানীতির যাঁতাকলে বে-সরকারী শিক্ষক সমাজ ও নন এমপিও শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গ

1

মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে গেছে। চোখ-মুখ জুড়ে কেবলই হতাশা, অপ্রাপ্তি আর বিষন্নতার ছাপ। জেকে বসেছে সংসারের অসংখ্য চাহিদাও। বুকের ভেতরে কষ্টের দগদগে ক্ষত নিয়ে বেশ আনমোনা হয়ে গেছেন মো.ফিরোজ আল আসাদ। বয়সও ফুরিয়ে আসছে তার।
জীবন তরঙ্গে আজ ভাটা পড়ছে। কন্ঠে আর উচ্চারিত হয়না জ্ঞানের বাণী, সেখানে আজ ডাক পড়ছে ‘রিক্সা আছে, যাবেন ভাই!’ চোখ দু’টো আর স্বপ্ন দেখায়না। কষ্টের আবরণে ঢাঁকা পড়া অশ্রু সিক্ত চোখ জোড়া নির্বাক হয়ে কেবলই এদিক ওদিক যাত্রী খোঁজে।’ মানুষ গড়ার এই কারিগর জীবন-জীবিকার তাগিদে বেঁছে নিয়েছেন রাজপথে মানুষ বহনের কাজ। বয়সের অন্তিম লগ্নে এসে শুরু করেছেন জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। নিজেকে সোপিয়ে দিয়েছেন অটোরিক্সায়। হ্যান্ডেল হাতে মরণপণ সংগ্রাম করছেন প্রতিনিয়ত।
মো. ফিরোজ আল আসাদ নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ফুট এ্যান্ড ভেজিটেবল কাল্টিভেশন বিষয়ের ট্রেড ইন্সট্রাক্টর। একযুগ আগে তিনি ওই স্কুলে শিক্ষক হিসাবে চাকরি নিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা তাকে মর্যাদার পরিবর্তে দিয়েছে তিরস্কার। বেতনহীন চাকরি করছেন ১২ বছর ধরে। অসুস্থ মায়ের ঔষধ আর সংসারের খরচ জোগাতেই তিনি এভাবে এক বছর ধরে অটোরিক্সা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি যাত্রী নিয়ে এসেছিলেন গুরুদাসপুরে। তখন কথা হয় এই সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষকের সাথে।
শিক্ষক ফিরোজ আল আসাদ জানান স্ত্রী সাবিনা ইয়াছমিনসহ চার সদস্যর সংসার তার। ২০০৫ সালে তিনি শিক্ষক হিসাবে ওই স্কুলে চাকরি নেন। ১২ বছর অপেক্ষার পরও স্কুলটি এমপিও ভুক্তি হয়নি। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি অটোরিক্সা কিনেছেন। সকালে স্কুেল ক্লাস করান আর বিকালে অটোরিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুধু ফিরোজ-ই নন ভৌতিক নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়েছে ফিরোজের মতো অসংখ্য শিক্ষকের ভাগ্য। বিধি অনুযায়ী স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও অনার্স পর্যায়ে শিক্ষক কর্মচারি নিয়োগ দেওয়া হলেও নিয়োগপ্রাপ্ত এসব শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তি ও স্তর পরিবর্তন হয়নি। ডিরেক্টর জেনারেল এর (ডিজি) হাতে ঝুলে রয়েছে এদের ভাগ্য। ফলে ননএমপিও এসব শিক্ষকরা জীবিকার তাগিদে শিক্ষকতার পাশাপাশি বেঁছে নিয়েছেন ভিন্ন পেশা। বর্তমানের মত অতীতেও এরকম এমপিও ভুক্তির দাবিতে রাজপথে সংগ্রাম করতে গিয়ে রক্ত দিয়েছেন অনেক শিক্ষক। পুলিশের লাঠি চার্জ, জল কামান-মরিচের গুড়ায় স্তব্ধ হয়েছে দাবি আদায়ের এসব কন্ঠ। কিন্তু জাতির বিবেক নামক এসব শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাতা উল্লেখ করে বলেছেন-“আমার দুর্ভাগ্য আমি শিক্ষক হতে পারিনি”। আপনারা জাতি গঠনে যে অবদান রাখছেন তা অবশ্যই জাতি সম্মানের সাথে মনে রাখবে। সরকারী কলেজের প্রভাষকদের ১৪০ তম বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনীর এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, আমি আপনাদের সঙ্গে জোগালী হিসাবে আছি। আপনারা জাতিকে শক্তিশালী হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এ মহৎ কাজ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অথচ এই জাতির বিবেকেরা না খেয়ে মরছে সে খবর কেউ রাখছেন না। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৮০ ভাগ অবদান রাখছেন এই বে-সরকারী শিক্ষকরা। শুধুমাত্র একটি জি.ও (গর্ভামেন্ট অর্ডার) নামক শব্দের কারণে। আর কে-ইবা এই শব্দের জন্ম দিল। কেনই বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধিভুক্তি দেয়া হয়। যার জন্য হাজার হাজার শিক্ষক বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিনা বেতনে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে জাতি গঠনে ভুমিকা পালন করছেন। মানুষ যদি পৃথিবীর নিকৃষ্ট প্রাণিকেও প্রতিপালন করে, তাহলে তাকে অন্তত দুবেলা দুমুঠো খেতে দেওয়া হয়। আমার দুর্ভাগ্য আমি একজন শিক্ষক। সেই সুবাদে অনেক কাছ থেকে দেখেছি নন এমপিও শিক্ষকদের করুণ এই দৃশ্যগুলো। দেখেছি তাদের অটোরিক্সা চালাতে, অভার টাইম দোকানে কাজ করতে, দেখেছি চোখের সামনে শিক্ষকের অকাল প্রয়াণও। বিভিন্ন খবরের কাগজের শিরোনাম হতেও দেখেছি।“ অটোরিক্সায় বাঁধা শিক্ষকের জীবন”,“ চলে গেলেন এমপিওর আশা বুকে নিয়ে না ফেরার দেশে” ইত্যাদি শিরোনামও।
শিক্ষকের আবরণে ঢাঁকা অবহেলিত এসব মানুষগুলো কেবল পত্রিকার পাতায় লেখনির শিরোনামই হলেন। সেই সংবাদ কেউ পড়লেন, কেউ পড়লেন না। দিন শেষে নিপীড়িত দূর্ভাগা শিক্ষকের ক্রন্দনমূর্ত সেই গল্প জায়গা পেল ময়লা আবর্জনার ভাগারে। তাঁরা না পারে কইতে, না পারে কারো কাছে হাত পাততে। পরকালের চিন্তা করে, না পারে আত্বহত্যা করতে। নাটাই ছাড়া ঘুড়ির মত ঘুড়ে বেড়ায় দ্বারে দ্বারে কিন্তু এসব ব্যাপারে কারো মাথা ব্যথা তো দেখিইনি, শুনিনি কারো আশ্বাসের বাণীও। উল্টো দেখেছি শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে মানব বন্ধন, অহিংস আন্দলোনসহ বিভিন্ন শান্তিপুর্ণ কর্মসূচিতে মরিচের গুড়া,গরম পানি আর রাবার বুলেট ছুড়তে। একবুক হতাশা, অপ্রাপ্তি আর দূঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে শিক্ষকরা এখন শিরোনামহীন খবরে রুপান্তরিত হয়েছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকা সত্বেও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর দ্বন্দ্বের কারণে বারবার আবেদন নিবেদন করেও নন-এমপিও শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছেনা। উপরন্ত এ পর্যন্ত যারা এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন তা শুধুই তাদের “নেতিবাচক রাজনীতির কেচ্ছা-কাহিনী মাত্র। আর এ জন্য যে শুধু বর্তমান আ’লীগ সরকারী দায়ী তা নয়। বিগত বি এন পি জোট সরকারের আমলেই এই জিও নামক যন্ত্রনার সৃষ্টি হয়। ওনারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও দিতে পারলেন না ভাল কথা, কিন্তু জিও নামক যন্ত্রনার সৃষ্টি করে গেলেন কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই। যার খেশারত নন এমপিও শিক্ষকদের দিতে হচ্ছে পদে পদে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দূর্বলের উপর সবলের আঘাত চিরায়াত। সর্বশেষ এই সরকারও একই পথে হাটতে শুরু করেছেন। বে-সরকারী শিক্ষকরা ৫ বছর পর অন্তত একবার হলেও পে-স্কেল পেতেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ঢাক ঢোল
পান্তা আছে ইলিশ নাই, বৈশাখ আছে ভাতা নাই, নিয়ম আছে প্রয়োগ নাই। নিয়ম অনুসারে পে-স্কেল বন্ধ হলে ৫% ইনক্রিমেন্ট বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, বৈশাখি ভাতাসহ সকল সুবিধা দেবার কথা। কিন্তু কই…? শিক্ষকরা আজ ছেড়া কাগজের মত দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে কাজের শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলছেন। তাঁরা আজ গাল ভর্তি পাকা দাড়ি, ছেড়া ময়লা প্যান্ট পড়ে পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ান তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। আর ফেরি করে জ্ঞান বিতরণ করে বেড়ান বাড়ি বাড়ি। চ্ষ্টো করেন জীবনের হিসাব মেলানোর। চেষ্টা করেন স্ত্রী ছেলে মেয়ে আর বৃদ্ধ অসহায় বাবা মা’র দুঃখের চিহ্ন অগোচরে মুছে দিতে।
সর্বশেষ শিক্ষকদের কান্নার রোল দেখলাম জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে নন এমপিও শিক্ষকরা বাড়ী ফিরলেও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেট কেমন হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। প্রতিশ্রুতি অনুসারে অধিভুক্ত সকল নন এমপিও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে এমপিওর আওতায নিয়ে আসা হবে বলে জানা যায়। অনেক পুরাতন প্রতিষ্ঠান আছে সকল শর্ত পূরণ থাকা সত্বেও ১৫-২০ বছরে শুধু স্তর পরিবর্তনের নামে হয়রানী করা হচ্ছে। অথচ ২০ বছর যাবৎ ভাল ফলাফল করে আসছে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো। পুরো বাংলাদেশে এরকম স্তর পরিবর্তন জটিলতায় আটকে আছে হাজারো বে-সরকারী প্রতিষ্ঠান।
এমনই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাটোরের গুরুদাসপুরের রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ। কলেজটি ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিও ভুক্ত হয়। সর্বশেষ ২০০১ সালে স্নাতক (পাস কোর্স) খোলা হয়। ২০০৩ সালে অধিভুক্ত হয়। অধিভুক্তির ১৭ বছর অতিবাহিত হলেও উপজেলার সর্বোচ্চ ফলাফল করা এই প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র স্তর পরিবর্তন নামের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে। একারণে বেতন ভাতাদি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চলনবিলের পিছিয়ে পরা নারীদের উচ্চ শিক্ষার একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা। কলেজের ২২ জন শিক্ষক কর্মচারি দীর্ঘ ১৮ বছর যাবৎ অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। এরকম সারা দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে হাজারো শিক্ষক কর্মচারি মানবেতর জীবন যাপন করছেন দীর্ঘ দিন ধরে। এটি অত্যন্ত লজ্জার ও দুঃখজনক ঘটনা। এমন লক্ষ লক্ষ শিক্ষক কর্মচারিদের অভুক্ত রেখে কিভাবে উন্নয়নশীল দেশের তকমা ধরে রাখা সম্ভব তা বোধগম্য নয়।
হয়তো এই লেখাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সুশীল সমাজ, এমপি-মন্ত্রী, উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ও এলিট শ্রেণীর লেখকদের দৃষ্টিগোচর হলেও তা ভ্রক্ষেপ করবেন না। তবুও শান্তনা পাব এই ভেবে যে, নন এমপিও বেসরকারী শিক্ষকদের দুঃখ দুর্দশার কথা কিছুটা হলেও বলার সুযোগ পেয়েছি। পরিশেষে আমার সহকর্মী অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক (নন এম পিও) সদ্য প্রয়াত হেলাল উদ্দিনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে কবির ভাষায় বলতে চাই “ আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”।

 

1 টি মন্তব্য
  1. বি এ কলি বলেছেন