৮৬ বছরেও খেয়া নৌকায় মানুষ পার করেন ‘রাজা মাঝি’

0

গুরুদাসপুর (নাটোর) সংবাদদাতা 

খেয়া নৌকা বেয়ে দশ গ্রামের মানুষ পারাপার করেন রাজা মাঝি। মানুষ পারাপার করেই চলে তার সংসার। এখন রাজা মাঝির বয়স ৮৬ বছর। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। শরীর জুড়ে বার্ধক্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেন না। কানেও শোনেন না ঠিকমতো।

তবুও সব প্রতিকুলতা ছাপিয়ে রাজা মাছি এখনো সেই পেশাতেই আছেন। প্রভাত ফেরি থেকে সন্ধ্যা নাগাদ রাজা মাঝি বৈঠা ঠেলে পথচারীদের গুমানী নদী পারাপার করেন। প্রতি যাত্রায় অন্তত ১৫ জন যাত্রি উঠেন তার এই খেয়া নৌকায়।

দুই হাতে বৈঠা ঠেলে খেয়া নৌকাতেই কেটে গেল রাজা মাঝির ৫১ টি বছর। এখন গুমানী নদীতে ভাটা পড়েছে। ভাটা পড়েছে রাজা মাঝির যৌবনেও। তবুও টানা অর্ধশত বছর এই একই পেশাতেই আছেন রাজা মাঝি।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, রাজামাঝি ধন সম্পদে রাজা না হলেও খেয়াঘাটের রাজা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপার, তাঁদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগীতায় অবদান রয়েছে তার। তাছাড়া রোদ,বৃষ্টি- ঝড়ের সময় অপেক্ষমান যাত্রীদের পারাপারের দক্ষ নাবিক এই রাজামাঝি।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ৪ নম্বর মশিন্দা ইউনিয়নের বাহাদুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রাজা মাঝি। বাড়ি সংলগ্ন গুমানী নদীতে খেয়া নৌকায় মানুষ পারাপাড়ের কাজটি করছেন তিনি। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রে মো. রাজা উল্লা মন্ডল (জন্ম তারিখ ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২) উল্লেখ রয়েছে। তবে এলাকায় তিনি রাজা মাঝি নামেই পরিচিতি।
গতকাল বুধবার রাজা মাছির খেয়া খাটে গিয়ে দেখাগেল- উদোম শরীর। চামড়ায় পড়েছে বার্ধক্যের ভাঁজ। শরীরজুরে রগ জেগে গেছে। মাথায় সাদা কাপড় জড়িয়ে শক্ত হাতে বৈঠা বেয়ে খেয়া নৌকায় যাত্রী পারাপার করছেন।

নৌকায় ৮-১০জন যাত্রী রয়েছেন। নদীর পানিতে ভাটির টান, প্রচন্ড ¯্রােত উপেক্ষা করেই পারাপারের কাজটি করছেন তিনি। শরীরে শক্তি, চোখের দৃষ্টি ঠিক থাকলেও কথা বলতে পারেন না তিনি। আধাভাঙা কথায় শুধুই বলেন ‘ পারাপারে ১০ ট্যাকা’।
নৌকার যাত্রী আবিদ মুন্সি ও রায়হান প্রামানিক বলেন,পাঁচ দশক ধরে মানুষ পারাপারের কাজ করছেন তিনি। এলাকার সব মানুষকেই কম বেশি চেনেন। গ্রামের প্রায় সব বাড়ি থেকেই মাসোয়ারা পান। অপরিচিত মানুষ হলে পারাপারের জন্য ১০ টাকা করে নেন তিনি। কেউ তাকে ঠকায়না।

বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন  মুক্ত প্রভাতকে জানালেন, যুবক বয়স থেকেই জীবীকা হিসেবে মানুষ পারাপারের পেশাটি বেছে নিয়েছিলেন রাজামাঝি। নাটোর-সিরাজগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী বাহাদুরপাড়া গ্রাম। একটা সময় প্রমত্ত ছিল গুমানী নদী। সাঁতরে পার হওয়া কঠিন ছিল। এখন নদীর সাথে রাজা মাঝির যৌবনেও ভাটা পড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক আবু শামা মন্ডল মুক্ত প্রভাতকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপারে অবদান রয়েছে এই মানুষটির। দেশ স্বাধীন হলেও রাজামাঝির ভাগ্য বদলেনি। জীবন-জীবিকা আর নদী -নৌকার মায়ায় এখনো বৈঠা হাতে নৌকা পারাপার করে চলছেন তিনি। বড়ই সহজ-সরল মানুষ তিনি।

রাজা মাঝির খোঁজ নিয়ে জানাগেল, তার তিন স্ত্রী। তিন পক্ষের ১৫ ছেলে ও ৫ মেয়ে। এদের মধ্যে মারা গেছেন ৫ ছেলে ও প্রথম স্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় তারা সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। ছোট স্ত্রী বৃদ্ধ হয়েছেন। তার ৫ ছেলে।

তাদের একজন মো.জামাল মন্ডল জানালেন, কী শীত, কী গরম। কাকডাকা ভোরে তার বাবা নৌকায় ওঠেন। বারন করলেও বৈঠা নিয়ে নৌকায় ওঠেন। নেশায় পরিণত হয়েছে। তার ভাষ্যমতে, অপরিকল্পিত সংসার ছিল বাবার। সংসারের ঘানি টানতেই নৌকার সাথে মিতালী গড়ে ওঠে তার। তবে তারা ৫ ভাই বড় হয়ে ওঠায় বাবার ওপর আর্থিক চাপ কমেছে।

খেয়াঘাটটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ইজারা নিয়েছেন তিনি। মানুষ পারাপার করে প্রতিদিন ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। তাছাড়া গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বছরচুক্তিতে ফসলও তোলা হয়। এ আয়ের টাকায় বাবা-মায়ের জন্য একটি টিনের ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এখন সুখেই কাটছে তাদের দিন।

মশিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রভাষক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজামাঝি একজন খাঁটি দেশ প্রেমিক মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপারসহ নানাভাবে সহযোগীতা করেছেন তিনি। পরিষদের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগীতা দেওয়া হয়ে থাকে।

মুক্ত প্রভাত/হেনা আহম্মেদ

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.