এক ইউনিয়নেই প্রায় ৫ হাজার পুকুর, পাঁচ বছরে কমছে ৮শ হেক্টর ফসলি জমি

0


পাঁচ বছর আগেও বিলের জমিগুলোতে দিব্যি চাষাবাদ চলছিল। মহাজনের কাছ থেকে এলাকার দরিদ্ররাও কিছু জমি লিজ নিয়ে ফসল উৎপন্ন করতেন বছর জুড়েই। তাতেই দিনাতিপাত হতো কৃষকদের। এখনো ঠাঁয় পড়ে আছে সেসব জমি। তবে বদলেছে চিত্র। পরিবর্তন এসেছে জমির মালিকানায়।
প্রান্তিক কৃষকদের পাঁচ বছর আগের ফসলি জমি এখন এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে। সেসব জমিতে আর চাষাবাদ হয়না। আপাত দৃষ্টিতে যতদুর চোখ যায় মাটির উঁচু উঁচু পাড়। এসব পাড় ঘেরা একটার পর একটা পুকুর। অবৈধভাবে পুকুর খননকৃত জমির তালিকায় শুধু যে কৃষকের ফসলি জমি যাচ্ছে তা নয়। সরকারী খাস খতিয়ানের জমিও বাদ যাচ্ছেনা। তবুও প্রসাশন নিরব-নির্বীকার। এখন গুরুদাসপুর উপজেলাজুড়ে পুকুরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার। এরমধ্যে সব চেয়ে বেশি পুকুর খনন করা হয়েছে উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, প্রায় ৫ হাজার পুকুর রয়েছে এই ইউনিয়নেই।
জলাবদ্ধতার কবলে চাপিলা,- চাপিলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তথ্যমতে,- এই ইউনিয়নে কৃষি জমির মোট আয়তন ৯৫.১২ একর। এই আয়তনের তিন শতাংশ কৃষি জমিই এখন পুকুর। স্থানীয় চেয়ারম্যান আলাল উদ্দিন ভুট্ট বলেন,- তার ইউনিয়নের মহারাজপুর, কান্দাইল, বৃ-চাপিলা, গযেন্দ্র চাপিলা, পম পাথুরিয়া, খিদির গরিলা, খিদির চাপিলা, বৃ-পাথুরিয়া, খামার পাথুরিয়ায় এলাকায় প্রায় ৫ হাজার পুকুর খনন করা হয়েছে। এসব পুকুরে বিষাক্ত খাদ্যে চাষ করা মাছ মরে গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। সামান্য বৃষ্টিতে গ্রামের পাকা সড়ক, মেঠোপথ এমনকি ঘরবাড়ি ঢুবে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীসহ জন-জীবনে। চাপিলা ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান,- প্রসাশনের তৎপরতা না থাকায় পুকুর খনন বন্ধ হয়নি। চাপিলা ইউনিয়নের প্রতিটি বিলের জমিতেই তিন ফসল উৎপন্ন হতো। বছরজুড়েই নানা ধরনের মওসুমি ফসল উৎপন্ন করতেন কৃষক। তাছাড়া পুকুরের মাটি বহনকারী ট্র্যকটরের যত্রতত্র চলাচলে গ্রামিণ সড়কগুলোও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
পুকুর গিলছে ৮শ হেক্টর ফসলি জমি,- গুরুদাসপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে,- পুকুর শুধুযে জনজীবন বিষিয়ে তুলছে তা নয়। পুকুরের কারনে মারাত্মক ফসলহানীর ঘটনা ঘটছে। বিগত পাঁচ বছরে গুরুদাসপুর উপজেলার বিলগুলোর প্রায় ৮শ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। তথ্যমতে,- ২০১১ সালেও গুরুদাসপুর উপজেলাজুড়ে ফসলি জমির পরিমান ছিল ১৬৬০৯ হেক্টর। ওই সালে ৭০ হেক্টর, ২০১২ সালে ৮০ হেক্টর, ২০১৩ সালে ৯৫, ২০১৪ সালে ১০৫, ২০১৫ সালে ১২০, ২০১৬ সালে ১৩০, ২০১৭ সালে ১১৫ হেক্টর জমি কমেছে। কমে যাওয়া জমির শ্রেণি এখন পুকুর।
পুকুরের সঠিক হিসাব নেই,- মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের চলতি বছরের জরিপ অনুযায়ী গুরুদাসপুর উপজেলাজুড়ে বেসরকারী পুকুরের হিসাব দেওয়া হয়েছে ৫৪৩৫টির। সরকারী রয়েছে ৩২টি। উপজেলা মৎস্য অফিসের চালানো ২০১৭ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে,- সেসময় উপজেলায় বেসরকারী পুকুরের সংখ্যা ছিল ৪৬৪৯ টি। এসব পুকুরের জলায়তন ছিল ১৩৬৭ হেক্টর জমি। এই জরিপের পর ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের শুরুর দিকে ৮৬টি পুকুর নতুন করে খনন করা হয়েছে। এরপর যে পুকুর খনন করা হচ্ছে তার কোন হিসাব নেই।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন বিল ঘুরে দেখা গেছে,- সরকারী আর ব্যাক্তি মালিকানা মিলে পুকুর খনন করা হয়েছে শত শত হেক্টর জমিতে। উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের রানীগ্রাম বিলে দেখা গেছে সরকারের খাস জমিদখল করে পুকুর খনন করা হচ্ছে। পৌর সদরের দক্ষিণ নারিবাড়ি বিলে পানি চলাচলের কালভার্ট বন্ধ করে পুকুর খনন চলছে। ধারাবারিষা ইউনিয়নের সোনাবাজু উচ্চবিদ্যালয় ঘেঁষে পুকুর খনন করা হয়েছে। চাঁপিলা ইউনিয়নের সড়কগুলো ডুবে গেছে। জলাবদ্ধ রয়েছে শত শত বিঘা জমি। সবমিলিয়ে উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দশ হাজারেরমতো এছাড়া বিয়াঘাটের হাঁড়িভাঙ্গা বিলে খনন করা হয়েছে প্রায় ৫০টিরও বেশি পুকুর। এসব এলাকায় অধ্যবদি পুকুর খনন চলছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলছেন, ৩১২ একর আয়তনের হাঁড়িভাঙ্গা বিলটিতে বোরো ৫২০ মেট্রিকটন, রোপা আমন ১১২ মে.টন ও বোনা আমন ১৭৫ মে.টনসহ মোট ৮০৭ মে.টন আবাদ হয়। বর্ষাকালে বিলটি তলিয়ে গেলেও সেখানে বোনা আমন ও উঁচুতে রোপা আমনের আবাদ হয়-বছর জুড়েই। অথচ নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এই বিলে নির্বিচারে ৫০টিরও বেশি পুকুর খনন করায় আশক্সক্ষাজনক হাড়ে কমছে ফসলি জমি। নিচু জমিগুলোতে সৃষ্টি হচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। শুধু হাঁড়িভাঙ্গা বিল নয়। চাঁপিলাসহ উপজেলাজুড়ে বিগত পাঁচ বছরে শত শত হেক্টর ফসলি জমি কমেছে পুকুর খননের কারনে। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
প্রান্তিক চাষি আবুল মিয়া, আখের আলী ও মুনছের মৃধাসহ অন্তত দশজন চাষি জানালেন,- পুকুর খনন বন্ধে যোগেন্দ্রনগর, বিলহরিবাড়ি, সাবগাড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরার অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিছুদিন পুকুর খনন বন্ধ থাকলেও পরে আবার শুরু হয় ফসলি জমি ধ্বংসযজ্ঞ। এখন আনাচেকানাচে শুধু পুকুর আর পুকুর।
আবু তাহেরসহ হাঁড়িভাঙ্গা বিলে জমি থাকা অন্ততপক্ষে ১৫জন কৃষক জানান, পুকুরের পাড়গুলো উঁচু হওয়ার কারনে সাধারন কৃষকের কৃষি জমিগুলো নিচে পড়েছে। তাদের জমিতে চলাচলের পথ বন্ধ। চাষের লাঙল, সার-কীটনাশক নিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। পানি নিষ্কাশনের পথগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ায় জমে থাকা পানি নামতে পারছে না। এখন বিলে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বছর খানেক ধরে এসব জমিতে কোন প্রকার চাষাবাদ করা যাচ্ছেনা। গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহম্মদ মনির হোসেন বলেন,- পুকুর খনন বন্ধে প্রশাসন তৎপর রয়েছে।
সাংসদও পরাস্ত হলেন-, সর্বশেষ নাটোর জেলা আ.লীগের সভাপতি গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম আসনের সাংসদ আব্দুল কুদ্দুস গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), গুরুদাসপুর থানার অফিসার ইনচার্জ নিয়ে উপজেলার পুকুর খনন বন্ধে কয়েকটি গ্রামে অভিযান চালিয়েও পুকুর খনন বন্ধ করতে পারেননি।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.