কবি শেখ ফজলল করিমের ৮২তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ

0

শাহিনুর ইসলাম প্রান্ত,লালমনিরহাট প্রতিনিধি

‘কোথায় স্বর্গ/কোথায় নরক কে বলে তা বহুদুর /মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক /মানুষেতে সুরাসুর’ কবি শেখ ফজলল করিমের এ মর্মস্পৃশী কবিতাটি ছোট বেলায় পড়েননি এমন লোক খুজে পাওয়া দুষ্কর। আজ  শক্রবার (২৮ সেপ্টেম্বর) এ অঞ্চলের গৌরব শত সহস্রগুণ বাড়িয়ে দেয়া কবি শেখ ফজলল করিমের ৮২তম মৃত্যুবার্ষিকী। দিবসটিকে ঘিরে সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সামিজিক সংগঠনগুলোতে তেমন আযোজন নেই বললেই চলে। এক প্রকার নিরব নিভৃতে চলে যায় এই কবির মৃত্যু দিন। অথচ এই কবি শত বছর আগে কবিতা ছাড়াও প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, জীবনগ্রন্থ, ইতিহাস, গবেষনামূলক নিবন্ধ, সমাজগঠন মূলক তত্বকথা গল্প, শিশুতোষ সাহিত্য, নীতিকথাচরিত গ্রন্থসহ বিভিন্ন সমালোচনা মূলক রচনা লিখে বাংলার সাহিত্যকে করেছিলেন সমৃদ্ধ। তার লেখা তৎকালীন সমাজ চেতনাকে নিয়ে গিয়েছিল ভিন্ন এক প্রবাহে। কবি শেখ ফজলল করিমের নামে কাকিনায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় করা হউক এটা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

কবির জন্মঃ কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদের জন্ম সাল ও তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মোঃ আব্দুল কুদ্দুস সম্পাদিত ‘শেখ ফজলল করিমের কবিতা’ নামক বইয়ে কবির জন্ম তারিখ ১৮৮২ সালের ৯ এপ্রিল মোতাবেক ১২৮৯ বঙ্গাব্দের ৩০ চৈত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কেউ কেউ কবির জন্ম তারিখ ১৮৮৩ সালের ১৩ এপ্রিল উল্লেখ করেছেন।

জন্মস্থানঃ কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ তৎকালীন রংপুর জেলা এবং বর্তমানে লালমনিরহাট জেলার ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক কাকিনায় জন্মগ্রহণ করেন।

পারিবারিক পরিচিতিঃ কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদের পিতা আমীর উল্লাহ্ সরদার কাকিনা মহারাজার একজন বিশ্বস্ত রাজ কর্মচারী ছিলেন। তৎকালে তাঁর পিতা একজন বেশ ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মাতার নাম কোকিলা বিবি।

শিক্ষা জীবনঃ কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ ৪/৫ বছর বয়সে কাকিনা মিডল ইংলিশ স্কুলে, যা বর্তমানে কাকিনা মহিমা রঞ্জন স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়— সেখানে ভর্তি হন। তৎকালীন ‘রঙ্গপুর দিক প্রকাশ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হরশঙ্কর মৈত্রেয় তাঁর বাল্য শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১৮৮৯ সালে মিডল ইংলিশ পরীক্ষায় ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে পরবর্তীতে রংপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু নানা কারণে তিনি সেখানে বেশিদিন পড়তে পারেন নি এবং বলতে গেলে তখন থেকেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটে।

বৈবাহিক জীবনঃ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলে ১৮৯৬ সালে কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ কাকিনার পার্শ্ববর্তী এলাকা গঙ্গাচড়ার কোলকোন্দের বসিরন নেছা খাতুন নাম্নী এক বিদুষী মহিলার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আর এভাবেই অল্প বয়সে কবি সাংসারিক জীবনে জড়িয়ে পড়েন।

চাকুরি জীবনঃ ১৯০১ সালে কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ ‘মেসার্স এমভি আপকার কোম্পানি’ নামক এক কোম্পানিতে মাসিক ২০ টাকা বেতনে চাকুরি লাভ করেন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯০২ সালে ‘এক্সট্রা এসিস্টেন্ট ম্যানেজার’ হিসেবে চাকুরিতে তাঁর পদোন্নতি ঘটে। কিন্তু এর অল্প কিছুকাল পরে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য ঘটলে তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দেন।

সাহিত্য সাধনাঃ কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ খুব অল্প বয়স থেকেই সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন হন। তিনি শৈশবকালেই ‘সরল পদ্য বিকাশ’ নামক একটি শিশুপাঠ্য কবিতার বই রচনা করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পাঠ এবং নানা প্রবন্ধ ও কবিতা রচনা করে সময় কাটাতেন। তিনি রাতে সামান্য ঘুমটুকু বাদে বলতে গেলে সর্বদাই ইবাদত-বন্দেগি ও অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকতেন। তৎকালে তিনি কাকিনা থেকে একটি ভালো মানের পত্রিকা প্রকাশের প্রত্যাশায় তাঁর নিজের সঞ্চিত দেড় সহস্রাধিক টাকা ব্যয়ে কাকিনায় ‘সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস্’ নামে একটি ছাপাখানা স্থাপন করে সেখান থেকে ‘বাসনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পত্রিকাটি ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হত। এছাড়াও ঐ ছাপাখানা থেকে ‘জমজম’, ‘কল্লোলিনী’ ও ‘রত্নপ্রদীপ’ নামেও পত্রিকা প্রকাশিত হত। তিনি ‘রংপুর সাহিত্য পরিষদ’-এর আজীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন সাহিত্য সমিতি ও সাহিত্য সম্মেলনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।

সাহিত্য সম্ভারঃ কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা অনেক। তন্মধ্যে তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মোট গদ্যগ্রন্থ সংখ্যা ৩৯টি এবং কাব্যগ্রন্থ মোট ৬টি বলে জানা যায়। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থ ও ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থগুলো হচ্ছেঃ— ‘ছামৌতত্ত্ব’, ‘লাইলী-মজনু’, ‘পথ ও পাথেয়’, ‘চিন্তার চাষ’, ‘মাথার মনি’, ‘বেহেস্তের ফুল’ ইত্যাদি। কাব্যগ্রন্থসমূহ হচ্ছেঃ— ‘তৃষ্ণা’, ‘পরিত্রাণ কাব্য’, ‘ভগ্নবীণা’, ‘ভক্তি পুষ্পাঞ্জলী’ ইত্যাদি। জীবনী গ্রন্থগুলো হচ্ছেঃ— ‘হযরত রাব্বানী সাহেবের জীবনী’, ‘বিবি খোদেজার জীবনী’, ‘বিবি ফাতেমার জীবনী’, ‘বিবি রহিমা’, ‘বিবি আয়েশার জীবনী’, ‘হযরত আব্দুল কাদের (রহঃ)-এর জীবনী’, ‘আমার জীবন চরিত’ ইত্যাদি। ইতিহাস গ্রন্থসমূহঃ— ‘আফগানিস্তানের ইতিহাস’, ‘আল হারুণ’, ‘রাজা মহিমা রঞ্জনের পশ্চিম ভ্রমণ’ ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁর কয়েকটি গদ্যনাটক, গীতিকাব্য, উপন্যাস, নাট্যকাব্য ও শোকগাঁথা রয়েছে।

সম্মাননা লাভঃ কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ তৎকালীন সমগ্র ভারতের বিভিন্ন বাংলা সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে অনেক সম্মাননা লাভ করেছিলেন। তিনি ১৯২০ সালে ‘নীতিভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ১৯২৩ সালে ‘নদীয়া সাহিত্য সভা’ কর্তৃক প্রদত্ত ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধি লাভ করেন। এছাড়াও তাঁকে ‘কাব্যভূষণ’ উপাধিতেও ভূষিত করা হয়।

জীবনাবসানঃ কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কাকিনায় ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর জন্মভিটা কাকিনায় তাঁর সমাধি সৌধ রয়েছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সাহিত্যানুরাগী তাঁর মাজার জিয়ারতের জন্য আসেন।

স্মৃতিঃ তাঁর স্মৃতিকে অম্নান করে রাখার জন্য লালমনিরহাট পৌরসভা এলাকায় কালেক্টরেট মাঠের পূর্বপাশে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শেখ ফজলল করিম শিশু নিকেতন ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

১৯৯৩ সালে লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের পাশে কাকিনায় কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি স্মৃতিফলক রয়েছে যা কবির বাড়ির দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। এছাড়া ২০০৫ সালে কাকিনায় কবি শেখ ফজলল করিম পাঠাগা নির্মিত করা হয়। লালমনিরহাট সদর হতে অথবা কালীগঞ্জ উপজেলা সদর হতে কবি শেখ ফজলল করিমের বাড়ি ও কবর দেখতে যাওয়া যায়। কালীগঞ্জ উপজেলা সদর হতে সড়ক পথে এর দুরুত্ব মাত্র ১০ কিলেমিটার। প্রবাহমান সময়ের গতিতে কবি শেখ ফজলল করিম চলে গেছেন প্রকৃতির নিয়মে ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে অনন্ত জীবনে। কিন্তু রেখে গেছে তার কিছু অসাধারণ সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করলে শত বছর পরেও আমরা পেতে পারি নতুন পথের দিশা।

মুক্ত প্রভাত/রাশিদুল

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.