হাত ধোয়া নিয়ে ছোট্ট আলোচনা

0 ১১

 

লিখেছেন- মোঃ আবুল বাশার।

আমরা সুস্থ্য থাকতে চাই। আর সুস্থ্যতার জন্য হাত ধোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হাত ধোয়া। সুতরাং কম-বেশি এ সম্পর্কে আমাদের সবারই জেনে থাকা প্রয়োজন।

কি?

আমরা আমাদের হাতের নখ থেকে শুরু করে হাতের কব্জি বা কনুই পর্যন্ত পানি দিয়ে ধৌত করাকে হাত ধোয়া বলে থাকি। আমরা অনেক সময় পানি না পেলে অনেক ফলের রস দ্বারা ধৌত করি বা অন্যান্য কাগজ বা টিস্যু দ্বারা হাত মুছে থাকি তাকে কিন্তু হাত ধোয়া বলতে পারি না।

কখন কখন হাত ধোয়া প্রয়োজন?

১। ঘুম থেকে উঠার পরে,

২। খাবার আগে ও পরে,

৩। খাবার তৈরি ও পরিবেশনের আগে

৪। শিশুকে খাওয়ানোর আগে ও পরে,

৫। শিশুর শৌচ কার্যের আগে ও পরে,

৬। পায়খানা ব্যবহারের আগে ও পরে।

তাছাড়াও কোন কাজ কর্ম যেমন ঘড়-দোর ঝাড় মুছ করার পর, সাইকেল, মোটর সাইকেল বা যান-বাহনের টায়ার লাগানো, ধৌতকরণ, কৃষি কাজে বা অন্যকোন কাজে বিষ প্রয়োগ বা কীটনাশক বা ক্ষতিকারক পদার্থ প্রয়োগ করার পর যা মানুষের ত্বক সহ যে কোন অঙ্গের জন্য ক্ষতিকর, নারীদের নিত্য দিনের কাজের আগে, বাহির হতে ঘরে ফিরে, রাস্তায় চলাচলের পর, ইত্যাদি।

কেন প্রয়োজন ?

উপরের সময়গুলোতে হাত ধোয়াকে সুস্থ্য থাকার শর্ত যখন বলছি তখন তার কারণ না বলাটা অযৌক্তিক। সুতরাং কেন আমরা তা করব জেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

১। ঘুম থেকে উঠার পর : আমরা যখন ঘুমাই তখন মূলত অচেতন অবস্থায় থাকি। ফলে ঘুমের সময়ে আমাদের হাত কোথায় থাকে তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারি না। এমনও হতে পারে আমাদের হাত গুপ্তাঙ্গে লাগতে পারে বা অন্য লজ্জাস্থান যেমন বগলে যেতে পারে। সারা দিনের ঘামের ফলে জমে থাকা জীবাণূ আমাদের হাতের মাধ্যমে প্রথমত মুখে বা অন্যভাবে আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। আবার যারা আমরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করি তারা অজু করার সময় এই সব নাপাকী লেগে যেন ওজুর সমস্ত পানিকে নষ্ট না করে সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়। আর এ বিষয়ে একটি হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। নবীজি (সাঃ) অন্যতম সাহাবী বুসর ইবনে আরতাতের বংশধর আবুল ওয়ালীদ আহমাদ ইবনে বাক্কার আদ্-দিমাশকী (রাযি.) থেকে- আব হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত। রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যদি রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে তবে সে হাতে দুই বা তিনবার পানি ঢেলে তা পাত্রে ঢুকাবে, কারণ সে জানে না তার হাত কোন কোন স্থানে রাত কাটিয়েছে। (তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ)

এছাড়া ঘুম থেকে উঠার পর যেহেতু নামায পড়ার জন্য অজু করতে হয়। সেহেতু হাত ধোয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে কোন অংগ ধোয়ার আগে হাত ধোয়ার প্রয়োজন হয়। নিশ্চয়ই এরও কারণ আছে। আর কারণটি হলো মানুষ যত কাজ কর্ম করে তার সবচেয়ে বেশি কাজ হাত দিয়ে করতে হয়। ফলে হাতে নানা রকম জীবাণু, ময়লা আবর্জনা লেগে থাকে আর আগে হাত না ধুলে সেসব শরীরের অন্যান্য অংশে লেগে থাকতে পারে। ফলে আগে হাত ধোয়া দরকার। আর এজন্য যখনই ওজু করার প্রয়োজন হোক না কেন অবশ্যই প্রথমে হাত ধুতে হবে। তাছাড় কর্ম ব্যস্ত মানুষের হাতে কেমিক্যাল, বহুবিধ রোগ-জীবাণূ ও ময়লা আবর্জনা লেগেই থাকে। ফলে হাত না ধুয়ে নিলে তো তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে বিনা বাধায়। আবার দেখা যায় ওজুর প্রথম শর্ত হাত ধোয়া এটি না হয়ে যদি হতো প্রথমে মুখে পানি দেয়া বা নাকে বা চোখে তাহলে কি হত একবার ভাবুন? আমার মনে হয়না এটি কোন সাধারণ চিন্তাভাবনার ফসল। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ভাষায় মানুষ যদি দিনের মধ্যে কয়েকবার ঠিক মতো হাত না ধৌত করে তাহলে একজিমা, ঘামাচি, তকের ইনফেকশন সহ অনেক চর্মজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

২। খাবার আগে ও পরে,

খাদ্য খাবার আগে হাত ধোয়া নিয়ে টেনশন না থাকলেও খাবার পরে হাত একমাত্র পাগল ছাড়া কেউ ধোয়া বাঁকি রাখে না। তবে হ্যাঁ খাওয়ার আগে এবং পরে উভয় সময়েই আজকাল অনেক শিক্ষিত বা উচ্চ স্ট্যাটাসধারী বলে আত্মস্বীকৃত কিছু জ্ঞানপাপী ব্যক্তিবর্গ তাদের হাত ধৌত করে না। এটা বিশেষভাবে শহরের বড় বড় রেস্টুরেন্ট, হোটেলে লক্ষ্য করা যায়। তারা পানি দিয়ে হাত ধোয়ার বদলে টিস্যু ব্যবহার করেন। তবে তাদের জ্ঞানপাপী বলার আগে বিষয়টি নিয়ে ভেবে নেয়াটা জরুরী। তারাই ঠিক নাকি এর উল্টোটা। আমরা খাই সাধারণত সকাল ৮.০০-১০.০০ টার মধ্যে, দুপুর ১.৩০-২.৩০ এর মধ্যে এবং রাত ৮.০০-১১.০০ টার মধ্যে। এবার লক্ষ্য করুন এই তিনটি সময়ের আগে আমরা অনেক কাজ করে থাকি। যার মাধ্যমে আমাদের হাতে অনেক রোগ জীবাণূ হাতে লেগে থাকতে পারে। হয়তো অনেকে বলতে পারেন আমি-তো অফিসে কাজ করি। তাদের ব্যপারেও মূলত একই কথা তারা যে সব কাগজপত্র নাড়াচাড়া করেন বা কলম ব্যবহার করেন তা কি জীবাণু মুক্ত? অথবা যে সব পোশাক ব্যবহার করেন? না। সুতরাং শুধুমাত্র ভদ্রতার দোহাই দিয়ে নিজের কতবড় সর্বনাশই না ডেকে নিয়ে আসছি? খাবার পরে আমরা হাত ধৌত করি মূলত খাওয়ার পরে যে খাদ্যের অংশটুকু লেগে থাকে তা পরিস্কার করার জন্য। কিন্তু খাওয়ার আগে হাত ধৌত করি বিভিন্ন কারণে। তার মধ্যে মূলত জীবাণূর ভয়ই মেইন। হাত ও হাতের আঙ্গুলের জোড় ও নখ ভালমতো না ধোয়ার কারণে টাইফয়েড, ডায়রিয়াসহ অনেক সংক্রামক ব্যাধিতে আমরা আক্রান্ত হই। আমরা চাই অনাকাঙ্খিত কোন বস্তু যেন হাতের মাধ্যমে সরাসরি আমাদের পেটের ভেতরে না যায়। অন্য কোন পদ্ধতিতে শরীরে না গিয়ে তা যদি সরাসরি মানুষের পেটে যায় তাহলে তার ক্ষতিকর প্রভাব অনেক বেশি। তাছাড়া আমরা অনেক সচেতন হলেও অন্যের মাধ্যমে পায়খানার জীবাণু পর্যন্ত আমাদের হাতে লাগে তা আমরা অনেক সময়ই ভাবি না। (আরেকদিন খাবার তৈরি ও পরিবেশন অংশে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে; কিভাবে মানুষের মাধ্যমে জটিল জীবাণু এমন কি পায়খানার জীবাণু পর্যন্ত খুব স্বাভাবিকভাবে আসে যা অকল্পনীয়)। হাত না ধুয়ে খাওয়ার ফলে অনেক সময় বিষ প্রবেশের ফলে মানুষ মারা গেছে এমন নজির দুনিয়ায় অনেক।

আমাদের প্রিয় নবি (সাঃ) খাবার আগে এবং পরে হাত ধৌত করতে বলেছেন।

* খাদ্য খাওয়ার আগে হাত ধোয়া ও কুলি করা (তিরমিযি)

* উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধোয়া (আবু দাউদ. তিরমিযি)

* হাতে চর্বি লেগে থাকলে (হাত ধোয়ার আগে) তা বাহুতে বা পায়ে মুছে নেয়া। (ইবনে মাজাহ)

* খাদ্য খাওয়া শেষে আঙ্গুলসমূহ যথাক্রমে মধ্যমা, তর্জনী, বৃদ্ধা, অনামিকা ও কনিষ্ঠ আঙ্গুল চেটে খাওয়া। (তিরমিযি, সামায়েলে তিরমিযি)

* খাদ্য খাওয়ার পর উভয় হাত ধোয়া। (তিরমিযি, আবু দাউদ)

* সালমান ফারসী (রাযি.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি তাওরাত কিতাবে পড়েছি যে, খাওয়া দাওয়ার পর অজু করলে বরকত হয়। এ বিষয়ে আমি নবিজির সাথে আলাপ করলাম, নবিজি (সাঃ) বললেন, খাওয়ার আগে ও পরে অজু করলে আহারে বরকত হয়। (শামায়িলে তিরমিযি, তিরমিযি, আবু দাউদ, আহমাদ, হাকেম)

* আনাস ইবনে মালিক (রাযি,) রাসুল সাঃ হতে নকল করেন, যে ব্যক্তি নিজ ঘরে বরকত বৃদ্ধি আকাঙ্খা করে সে যেন তার সামনে খাবার উপস্থিত হলে হাত ধুয়ে নেয় এবং তা তুলে নেওয়ার পরেও হাত ধুয়ে নেয়। (আখলাকুন নবি সাঃ, ইফাবা, হাদিস নং ৬৫৪, পৃষ্ঠা-৩০০, অক্টো.- ৯৪।)

* আহমদ ইবনে মানী (রহ.) আবু হুরায়রা রাঃ, রাসুল সাঃ হতে বর্ণনা করেন, শয়তান অত্যন্ত অনুভুতি সম্পন্ন এবং খুবই লোলুপ। নিজেদের ব্যাপারে তোমরা একে ভয় করবে। হাতে চর্বির গন্ধ নিয়ে কেউ যদি রাত যাপন করে আর হাতের যদি কোন ক্ষতি হয় তবে সে যেন, নিজেকেই মালামত করে।(মানে সে যেন নিজেকেই এর দায়িত্ব নেয়। (তিরমিযি) (খাদ্য খাওয়ার পরে যদি হাত ভালভাবে পরিস্কার না করা হয় তাহলে খাদ্যের গন্ধে পোকামাকড়, পিপড়া, ইদুর এসে দংশন করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক সময় অনেকে নখকে উইপোকা কামড়ে চামরা তুলে নিয়েছে বলে অনেক ঘটনা আমরা দেখেছি। তাছাড়া সে খাদ্যে অনেক সময় এমন কোন স্থানে লেগে থাকে যেখান থেকে পঁচে আরও রোগজীবাণুর আখড়া তৈরি করে। আবার হাত ধোয়ার পরে কাপড়ে হাত মুছে নেয়াকেও ইসলাম সমর্থন করে।

* আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দশটি জিনিস ফিতরাতের (মানুষের স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন প্রণালী) অন্তর্ভূক্ত। ১. মোঁচ (গোঁফ) কেটে ফেলা / ছাঁটা, ২. দাড়ি বড় করা, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. নাকে পানি দেয়া / পানি দ্বারা নাসা রন্ধ্র পরিষ্কার করা, ৫. হাত পায়ের নখ কাটা, ৬. (ওজু গোসলের সময়)আঙ্গুলের জোড় এবং গিরাসমূহ ধুয়ে ফেলা, ৭. বগলের চুল কাটা / বোগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা, ৮. নাভী মন্ডলের (যৌনকেশ) চুল কাটা, ৯. (পানির দ্বারা) ইস্তেঞ্জা করা (অর্থাৎ পেশাব পায়খানার পর পানি দিয়ে পবিত্রতা হাসিল করা)। বর্ণনাকারী বলেন (রাবী যাকারিয়া (রাঃ) বলেন, হযরত মুসআব (রাঃ) বলেছেন) দশমটি আমি ভুলে গেছি। সম্ভবত সেটি হবে কুলি করা। (মিশকাত শরীফ-হাদিস নং ৩৫০, রিয়াদুস সালেহীন হাদিস নং ১২০৪, মুসলিম শরীফ-হাদিস নং ৩৫০, আবু দাউদ শরীফ-হাদিস নং ৫৩, সুনানু ইবনে মাজাহ- হাদিস নং ২৯৩)।

(অসমাপ্ত)

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.